পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ২০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাইনর মেরামতের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০ লক্ষ টাকা নিয়ে নয় ছয় করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসার ও প্রধান শিক্ষকদের যোগসাজশে ওই টাকা মেরামতের কাজে ব্যবহার না করে আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা গেছে।
পিইডি ৪ এর আওতায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে নির্বাচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাইনর মেরামতের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করার জন্য ৮টি শর্ত দেওয়া হয়।
শর্তাবলীর ৫ নং পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়, বরাদ্দকৃত বিদ্যালয়ে মেরামতের প্রয়োজন না থাকলে অথবা রাজস্বখাত থেকে বর্তমান অর্থ বছরে বিদ্যালয় মেরামত বাবদ বরাদ্দ পেয়ে থাকলে অথবা এলজিইডি কর্তৃক মেজর মেরামতের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান থাকলে বরাদ্দকৃত এ অর্থ ব্যয় করা যাবে না। এক্ষেত্রে বরাদ্দপ্রাপ্ত অর্থ সমর্পণ করতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নতুন ভবন নির্মানের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় এবং নতুন ভবন নির্মান কাজ চলমান থাকা অবস্থায় ওই ভবনে মেরামতের বরাদ্দ হওয়ায় বরাদ্দকৃত অর্থ বিল ভাউচারের মাধ্যমে নয় ছয় করা হয়।
নতুন ভবনে মেরামতের প্রয়োজন না হলেও উপজেলা প্রকৌশলীর (এলজিইডি) নিকট থেকে ভুয়া ইসটিমেট তৈরি করে নেয় সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষক। আর এ ইসটিমেট অনুযায়ী তৈরি করা হয় ভুয়া বিল ভাউচার।
ভুয়া বিল ভাউচারে ১ লক্ষ টাকাই দেখানো হয় রং ক্রয় বাবদ। বাকি টাকা ফার্নিচার ও অন্যান্য মনগড়া ভাউচারে ব্যয় দেখানো হয়। সরেজমিনে গিয়ে ভাউচারের সাথে কাজের কোন মিল পাওয়া যায় না।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫৯ নং মাঝের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে নতুন ভবনের টেন্ডার হয়। কাজ শুরু হয় ২০১৯-২০ অর্থ বছরে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। আবার ২০২০-২১ অর্থ বছরেই ওই ভবন মেরামতের জন্য ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। টাকা কোথায় খরচ করা হয়েছে তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আঃ রাজ্জাক ও এসএমসি’র সভাপতি শহিদ মেম্বার।
১৩৭ নং উত্তর টিয়ারখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে নতুন ভবনের কাজ চলাকালীন ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, নতুন ভবন সংলগ্ন পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনটিতে কোন রকম রংয়ের প্রলেপ দিয়ে বিল ভাউচার করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ২ লক্ষ টাকা দিয়ে পুরাতন ভবনটিতে রং করা হয়েছে এবং কিছু বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।
এভাবে পশ্চিম সেনের টিকিকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম ভেচকি আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুষখালী বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্ধবপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব মিঠাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ২০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ চলাকালীন ক্ষুদ্র মেরামতের টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশটিতেই ২০২০-২১ অর্থ বছরে স্লিপ বাবদ ৫০ হাজার টাকা ও রুটিন মেইনটেন্যান্স বাবদ ৪০ হাজার টাকা প্রেরণ করেছে শিক্ষা অধিদফতর। তবে দৃশ্যমান কোন কাজ পরিলক্ষিত হয় না বলে দাবি স্হানীয়দের।
কোন কোন প্রধান শিক্ষক স্লিপ ও রটিন মেইনটেন্যান্সের টাকা দিয়ে বেঞ্চ তৈরি সহ আলমারি ও টেবিল ক্রয় করলেও তা ক্ষুদ্র মেরামতের ভাউচারে প্রকাশ করেন। ৩৫ নং নাগ্রাভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুয়া বিল ভাউচার গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট সংরক্ষিত আছে।
পরিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, মাইনর মেরামত কার্যক্রম বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে। অধিকাংশ প্রধান শিক্ষকরা এ শর্ত না মানলেও উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সংশ্লিষ্ট সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ম্যানেজ করায় কোন ঝামেলায় পরতে হয় না।
উপজেলার কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টাকা আত্মসাৎ করে পার পেয়ে যাওয়ারও চ্যালেঞ্জ করেন। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে মনে হয়, এখানে সরকারি কোন আইন চলে না। চলে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিজস্ব আইন।
শুধু যে নতুন ভবনে মাইনর মেইনটেন্যান্সের বরাদ্দ দিয়ে নয় ছয় করা হয় তা নয়। নতুন ভবন ছাড়াও পুরাতন ভবন মেরামতের কাজেও দেখা যায় ব্যাপক অনিয়ম।
১৩০ নং দক্ষিণ পূর্ব বাদুরতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভোট কেন্দ্র মেরামতের জন্য ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ০৯.০৩.২০২১ খ্রি. তারিখ প্রধান শিক্ষকের নিকট চেক হস্তান্তর করে উপজেলা শিক্ষা অফিস। অদ্যবধি ওই টাকার ১ টাকাও ব্যয় করা হয়নি। ব্যয় করা হয়নি ৫ বছরে বিদ্যালয়টিতে আসা স্লিপ ও রুটিন মেইনটেন্যান্স এর প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।
২০৬ নং নিজামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ লক্ষ টাকার বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যালয়ের চারপাশে তারকাটার বেড়া দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) আবু সাঈদ মোঃ কাজী জসিম তারকাটা বেড়া দেওয়ার জন্য আমরা কোন প্রাক্কলন তৈরি করি না।
এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ে কোন মেরামতের কাজ প্রয়োজন না থাকায় তাঁরকাটার বেড়া দিয়ে সরকারি টাকা অপচয় ও শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে।তবে প্রধান শিক্ষক বলেন, পরিপত্র অনুযায়ী শতভাগ কাজ করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোন সুফল পাওয়া যায় না। কোথাও অভিযোগ দিলে তদন্ত আসে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ওপর। শত অনিয়ম থাকলেও প্রতিবেদনে লেখা হয় ‘কোন অনিয়ম পাওয়া যায়নি’। একাধিক অভিযোগের কপি সংরক্ষিত আছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অচ্যুতানন্দ দাস জানান, মেরামতের জন্য বিদ্যালয়ের তালিকা অনেক সময় ঢাকা থেকে হয়। এজন্য নতুন ভবনেও মেরামতের টাকা বরাদ্দ হতে পারে। তবে এ বছর আমরা তালিকা পাঠিয়েছি। সে কাজগুলো আগামীতে হবে। আর এ বছরের মেরামত কাজে কোন অনিয়মের খবর পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিরোজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ জেছের আলী বলেন, মেরামতের বরাদ্দের জন্য কিছু তালিকা ঢাকা থেকেও হয়। এজন্যই একই বিদ্যালয়ে মেজর মেইনটেন্যান্স ও মাইনর মেইনটেন্যান্স বরাদ্দ হয়। তবে কাজে অনিয়ম হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।